This blog have moved to FFTsys's domain. Newer posts will appear on the new URL of the blog. Thanks for visiting.

Thursday, November 4, 2010

হুমায়ুন আজাদের কবিতায় শিল্প সুষমা


সাইফুজ্জামান

হুমায়ুন আজাদ বহুমাত্রিক লেখক। তার কবিতা, উপন্যাস ও গবেষণা সাহিত্য স্বতন্ত্র ধারা ও বিপুল প্রজ্ঞানির্ভর। বাংলা সাহিত্য বিশ্বসাহিত্যের বিপুল পাঠ থেকে উৎসারিত হুমায়ুন আজাদের রচনায় গভীর জীবন অন্বেষণ ও বিচিত্র অনুভবের প্রতিফলন প্রত্যক্ষ করা যায়। হুমায়ুন আজাদের কবিতা বিষয়বৈভব, নির্মিত ও বক্তব্যের যে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করেছে তা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করা যেতে পারে।

ষাট দশকে হুমায়ুন আজাদ কবিতাচর্চা শুরু করেন। সত্তর দশকে তার কবিতায় রোমান্টিক বক্তব্যের পাশাপাশি অ্যান্টি-রোমান্টিক বক্তব্য, বিষয়-প্রকরণ, সমাজ-পরিপার্শ্বের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ, শিল্পকুশলতায় সংবেদী প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তার কাব্যগ্রন্থ অলৌকিক ইস্টিমার (১৯৭৩), জ্বলো চিতা বাঘ (১৯৮৫), উপন কি ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল (১৯৮৫), সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে (১৯৮৫), কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু (১৯৯৮)-তে সামাজিক দায়বদ্ধতা, রোমান্টিক ভাবনা, যৌনচেতনা ও মানবিক সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা প্রতিবিম্বিত ও প্রতিসারিত। স্বদেশ, প্রকৃতি ও সমকাল তার আগ্রহের বিষয়। মানুষের জীবনের বিভিন্ন সময় কৈশোর, যৌবন ও পৌঢ়ত্বে যেসব অনুভব ক্রিয়াশীল থাকে তা তার চিন্তাজগৎ ও কর্মের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়। হুমায়ুন আজাদ কবিতায় তীক্ষ্ণ জীবনানুভূতি সঞ্চয় করেছেন। তিনি যখন যে সময়ের কথা বলতে চেয়েছেন সেসময় ও তার সমাজবাস্তবতা তার কাছে মুখ্য প্রতিপাদ্য হয়েছে। সাবলীলতা, শনাক্তকরণের বোধ ও প্রকাশের নিবিড় আকৃতি তার কবিতাকে নান্দনিকতার মর্যাদায় সিক্ত করেছে। বাককুশলতা তার কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে:

যেদিকে ইচ্ছে পালাও দুপায়ে এইটুকু থাক জানা
চারিদিক আমি
কাঁটাতারে ঘিরে সান্ত্রী বসিয়ে পেতে আছি জেলখানা
পশ্চিমে গেলে দেখবে তোমার অতুলনীয় স্বাস্থ্য খেতে ছুটে আসে
একটি বিশাল ডোরাকাটা বাঘ- শিক্ষিত সূর্যান্ত।
উত্তরে খুঁড়ে গভীর কবর জেগে আছি মিটমিট
সুস্বাদু ওই মাংসের লোভে শবাহারী কালো কীট
দক্ষিণে গেলে দেখবে দুলছে একটি ব্যাপক সিন্ধু
আমার অন্ধ চোখ থেকে ঝরা একফোঁটা জলবিন্দু।

জীবনের কল্লোল স্বাভাবিক, মৃত্যু অবধারিত। জীবনও মৃত্যুর মাঝে দাঁড়িয়ে মানুষ মোহগ্রস্ত জগৎ সংসারে বাস করে। প্রকৃতির সৌন্দর্য, মানুষের মানবিকতা, রাজনীতির ঘূর্ণি হুমায়ুন আজাদ উপভোগ করেছেন। এসব বিষয় তার কবিতায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে:

একনায়কের কামান মর্টার স্টেনগান
বধ্যভূমি হয়ে ওঠে দ্বাদশ পঙ্ক্তির
উপান্তি অবস্থিত বিদ্রোহী শহর
লালা গড়িয়ে গড়িয়ে স্বয়ংরচিত হয়ে ওঠে
ত্রয়োদশ চতুর্দশ পঙ্ক্তি এবং
টলমল করতে থাকে সমগ্র কবিতা
কাফনে মোড়া এক বিন্দু অশ্রু।

-- (কাফনে মোড়া অশ্রুবিন্দু: সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে)

হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিগত অনুভব ব্যক্ত করতে কখনও দুর্বলতা প্রকাশ করেননি। ছন্দ ব্যবহার, বাক্য নির্মাণ ও বক্তব্য উপস্থাপনা স্পষ্ট ও দৃঢ়। এসব বক্তব্যে অনায়াসে পাঠক একাত্ব হয়ে যায়। সন্তানের স্বাধীনতা ও আমিত্বের সত্য সন্ধানে ব্যাপৃত কবি পৃথিবীর সৌন্দর্য, আলোকিত জীবনের অর্থময়তা উৎস সন্ধান করেন। আগামীর সম্ভাবনা, ইতিহাসচেতনা ও ঐতিহ্য অন্বেষণা হুমায়ুন আজাদের কবিতায় তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল। তিনি সংকট ও সম্ভাবনাকে কবিতায় আÍীকরণ করেছেন। তার কবিতায় স্বতন্ত্রতা ও বিশিষ্টতার নতুন দিক চিহ্নিত। হুমায়ুন আজাদ তৃতীয় চোখ দিয়ে যা-কিছু দেখেছেন তা কবিতার অন্তর্গত উপাদান করেছেন। সূক্ষ্ম দৃষ্টিগ্রাহ্য প্রতিচিত্র যেমন আছে তেমন রয়েছে সিরিয়াস বিষয়ের প্রতিচ্ছবি। ‘হুমায়ুন আজাদ’ শীর্ষক আ স্মৃতিচারণ কবিতায় চারপাশের সমাজচিত্র অপসারিত হয়নি।

আমার সন্তান আজো জন্মেনি। যদি জন্মে
সে কি জন্মেই পাবে স্বাধীনতা? আমার বাবার
স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়েছিল আমার জীবনে।
আমার স্বাধীনতা কীরকম হবে আমার সন্তানের জীবনে?
নাকি তাকেই বলতে হবে আমার মতোই কোনদিন
এতদিনে স্বাধীন হলাম।
আমার সন্তান কী চাইবে জানি না। পরবর্তীরা সর্বদাই
অধিক সাহসী, তাদের চাহিদা অধিক।
আমি চাই আমার আলোক সত্য হোক তার মধ্যে
আমি শুধু চাইতে পারি তার মধ্যে সত্য হোক আমার জ্যোৎস্না
(হুমায়ুন আজাদ)

হুমায়ুন আজাদ হাজার বছরের বাঙালির সংস্কৃতি, জীবনাচরণ ও মানবিকতা কবিতায় স্থান করে দেন। তার কবিতা একদিকে মানবিক, সামগ্রিকভাবে বাস্তবতানির্ভর। হুমায়ুন আজাদ বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রহস্যজগতে প্রবেশ করে কবিতার উপকরণ সংগ্রহ করেন। তার কবিতা রহস্যালোকের অন্তর্ভেদী পর্দা খুলে দেয়। আশা-নিরাশা, স্বপ্ন-অপ্রাপ্তির দোলাচল মানুষের জীবনে যে দ্বান্দ্বিকতার জন্ম দেয় কবি হুমায়ুন আজাদের কবিতা সেসব অন্তর্গত বিষয়-আশয়ে সজীব হয়ে ওঠে। হুমায়ুন আজাদ সচেতন কবি। একজন সচেতন কবি চারপাশের ঘটনাপ্রবাহে নিবিড়ভাবে যুক্ত থাকেন। তার কবিতা সময়ের প্রতিদিনের কলরবে মুখর থাকে। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করেন:

সমাজের কালে কুকুরেরা
চিৎকারে সন্ত্রস্ত করে স্বপ্নলোক আতঙ্কিত পদ্ম জ্যোৎস্না ঘেরা
পশু ও মানুষ। অন্ধ রাজধানী ভরে প্রচণ্ড উল্লাস
সারা রাস্তায় চাই রক্ত মাখা ছিন্নভিন্ন ঘৃণ্যতম লাশ
(এক নায়কের পিস্তল বেয়নেট)

হুমায়ুন আজাদ প্রথাবিরোধী লেখক। গতানুগতিক ধারা ভেঙে তিনি কবিতা রচনা করেছেন। তার কবিতায় বক্তব্য ও ভাষাবিন্যাসে ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন বিপরীত স্রোতে দাঁড়িয়ে। তিনি ছিলেন অপ্রতিরোধ্য ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী। অসম সমাজব্যবস্থা কবিচিত্তে আলোড়ন তুলেছে। হুমায়ুন আজাদ সমাজচিত্র কবিতায় বন্দি করেন:

বাঙলার মাটিতে কেমন হচ্ছে রক্তপাত প্রতিদিন
প্রতিটি পথিক কিছু রক্ত রেখে যাচ্ছে ব্লাডব্যাংকে
বাঙলার মাটিতে জমা রাখে ভবিষ্যৎ ভেবে
বাঙলার সব রক্ত তীব্রভাবে মাটি অভিমুখী।
(ব্লাড ব্যাংক)

হুমায়ুন আজাদ মানুষকে সচেতন করার প্রয়াসী ছিলেন। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের মানুষ তার কবিতায় উঠে এসেছে। মানুষের মনোভঙ্গি, স্মৃতি, দুঃখ-কষ্ট, যাপিত জীবন ঘিরে কবির আগ্রহ। তিনি মানুষের মধ্যে খুঁজে পেতে চেয়েছেন শুভ্রতা। হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের সবুজ বনভূমি, উদার মানুষ ও নিসর্গের কাছে সমর্পিত। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামগ্রিক অবস্থা কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। কবির আÍপ্রতিকৃতিতে বাঙালির যৌথ পরিবার কাঠামোর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে:

বাবা ব্যর্থ ছিলেন আপনি আমার মতোই; সম্ভবত ১৯৯২ থেকে
দেখি না আপনাকে, মনে যে পড়ে খুব তাও নয়; কে কে
আপনাকে মনে করে? আপনার সন্তানেরা অতিশয়
ব্যস্ত নানা কাজে, আপনাকে ভাবার মতো কোথায় সময়?
মা, তোমাকেও দেখছি ক মাস ধরে ২০০৩-এর জুলাই
থেকে সম্ভবত ঠিক মনে নেই, তবে কখনো যাই
গ্রামে, বিশেষ যাই না, ঢুকি বিষণ্ন দোতলার ঘরে
ডাকতে গিয়ে মনে পড়ে তুমি শুয়ে রয়েছ কবরে।
তবুও তোমার পাশে একটু দাঁড়াই, কখনো প্রার্থনা
করি না; বিশ্বাস নেই ওতে, তবে হই আনমনা
একটুকু, তারপর চলে আসি; কখনো হঠাৎ নিজ স্বরে
শুনি বাবা আপনার স্বর একা বসে থাকি ঘরে
মনে হয় সন্ধ্যা নামছে সুর করে ডাকছেন নাম ধরে
খেলা রেখে ফেলার জন্যে; মা তোমাকে দেখি মাঝে মাঝে
দাঁড়িয়ে রয়েছো পথ চেয়ে, একলা হঠাৎ বুকে বাজে
টুকরো মৃদু স্বর। খুব যে কষ্ট পাই বাবা তোমার অভাবে
তা নয়; আমার পুত্র কন্যারা এভাবেই আমাকে ভুলে যাবে।

হুমায়ুন আজাদ বাস্তব সমাজ চিত্র তুলে ধরেছেন। কবি সমাজ পরিবর্তনকে প্রত্যক্ষ করেন। সভ্যতার উন্নতিতে সমাজ, সংস্কৃতি ও মানুষের জীবনের বহিঃঅন্ত ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া একজন কবি প্রত্যক্ষ করেন। ক্রমপরিবর্তনশীল সমাজে মানুষে মানবিকতা হারিয়েছে। ভাই ভাই-এর বুকে ছুরি বসাচ্ছে। বন্ধু বন্ধুর হত্যাকারী। এসব কবি হুমায়ুন আজাদকে উদ্বেলিত করেছে:

নিত্য নতুন ছোড়া ভোজালি, বল্লম উদ্ভাবনের নাম এ সভ্যতা
আমি যে সভ্যতায় বাস করি
যার বিষ ঢোকে ঢোকে নীল হয়ে যাচ্ছে এশিয়া
ইউরোপ আফ্রিকা
তার সার কথা হত্যা, পুনরায় হত্যা আর হত্যা
(পৃথিবীতে একটি বন্দুকও থাকবে না)

হুমায়ুন আজাদের কবিতার বিশ্লেষণ থেকে জরুরি তার কবিতার পাঠ। কবিতার উপস্থাপনায় যে শব্দ প্রয়োগ ও বিশেষ মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন তিনি সচেতনভাবে তা করেছেন। বাক্য গাঁথুনিতে দক্ষতা তার বিশেষ আগ্রহের। প্রচলিত অপ্রচলিত শব্দ কবিতায় ব্যবহার করে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন কবি হুমায়ুন আজাদ। মানুষের হিংস তার ক্রুরতা, কপটতা দেখে কবি দুঃখ পেয়েছেন। নেকড়ে মানুষ, হৃদয়হীন জনগোষ্ঠীর করুণ কর্মযজ্ঞে হুমায়ুন আজাদের কবিহৃদয় ক্ষতবিক্ষত। তবু মানুষ মানসিকতা উদ্ধার করতে পারে, এ বিশ্বাস তার মধ্যে প্রবলভাবে উপস্থিত থেকেছে।

সত্তর দশকে হুমায়ুন আজাদ ধূমকেতুর মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন। আশির দশক থেকে ক্রমাগত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়েছে তার কবিতা। ভাষা, উপস্থাপনা ও চিত্রকল্প ব্যবহার তার কবিতাকে দ্যুতিময় করেছে। বিস্তর কবিতা থেকে উদ্ধৃতি এনে কবি হুমায়ুন আজাদকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।

হুমায়ুন আজাদ বিভিন্ন ফর্মে কবিতা রচনা করেছেন। বক্তব্যের ভিন্নতার সঙ্গে নিজস্ব নির্মাণকৌশল ও বক্তব্যের ব্যঞ্জনা পাঠককে আকৃষ্ট করে। পাঠক অনায়াসে তার কবিতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারে। পাঠকের সঙ্গে নিজেকে সংযুক্ত করা সার্থক কবির কাজ। হুমায়ুন আজাদের সার্থকতা এখানেই। মৌলবাদী শক্তির উত্থান যখন ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তখন হুমায়ুন আজাদ কুংস্কার ও ধর্মান্ধকতার বিরুদ্ধে কণ্ঠ উচ্চকিত রেখেছেন। বাস্তবতার দিকে চোখ রেখে তাকে বলতে হয়:

আমার জন্যে কষ্ট পেয়ো না; আমি চমৎকার আছি।
থাকো উৎসবে, তোমাকে তারাই পাক কাছাকাছি
যারা তোমার আপন; আমি কেউ নই, তোমার গোপন
একান্ত স্বপ্ন, স্বপ্নের ভেতর কেউ থাকে কতোক্ষণ।
বেশ আছি, সুখে আছি, যদিও বিন্দু বিন্দু বিষ
জমে বুকে, শুনি ধ্বনি বলেছিলেন ‘ইশ লিবে ডিশ’।
(কষ্ট পেয়ো না, পেরোনোর কিছু নেই)

জীবনযাপনে বাধা-বিপত্তির মতো কবিতার রচয়িতাকেও যেতে হয় শাসকের রোষানলে; কবির ওপর ঝুলে থাকে ধর্মব্যবসায়ী খুর। হুমায়ুন আজাদের মতো একজন সৎ ও মহৎ কবি। সঙ্গত কারণেই কাফনে মোড়া তার অশ্রুবিন্দু, বেদনার্ত তার কণ্ঠ। জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে হুমায়ুন আজাদ কবিতা রচনা করেন। তার কবিতা হয়ে ওঠে মহৎ শিল্প।

যে কবি চেতনার গহিনে লালন করেন দ্রোহ তিনি সেই কবি। হুমায়ুন আজাদ নিজের সঙ্গে কখনও আপস করেননি। বাস্তবতাকে স্পর্শ করেছেন গভীর স্পর্ধায়। যৌন-আকাক্সক্ষা, প্রেম ও প্রকৃতির কাছে নিজেকে খুলে দিয়েছেন হুমায়ুন আজাদ। জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গে একরৈখিকভাবে যুক্ত করেছেন বিশ্বাস। স্পষ্ট ভাষণ, সত্য উচ্চারণ ও কুসংস্কারকে অস্বীকার করে সত্যের পথে এগিয়ে গেছেন হুমায়ুন আজাদ। তিনি কোন বিশেষ মুখোশে নিজেকে আড়াল করেননি।

দূরে, কাছে, ভেতর-বাইরে যে রহস্যময়তার জাল ঘিরে আছে তার মধ্যে ‘বস্তু’কে আবিষ্কার করার আগ্রহ কবি হুমায়ুন আজাদ লালন করেছেন। বস্তুত ভেতর থেকে ঠিকরে পড়া আলো ও অস্তিত্ববাদিতা নিজেকে সমর্পণ করেছেন কবি। দ্বিধাহীন উচ্চারণ:

অনেক অভিজ্ঞ আমি, গতকালও ছিলাম বালক
মূর্খ জ্ঞানশূন্য অনভিজ্ঞ; আজ আমি মৃতদের সমান অভিজ্ঞ
মহাজাগতিক সমস্ত ভাঙন চুরমার ধরে আছি আমি
রক্তে মাংসকোষে, আমি আজ জানি কীভাবে বিলুপ্ত হয়
নক্ষত্রমণ্ডল, কিভাবে তলিয়ে যায় মহাদেশ
অতল জলের তলে। রক্তে আমি দেখেছি প্রলয়, চূড়ান্ত আগুন
ধসে পড়ছে অজয় পর্বত, মূর্খ ছুটে এসে ভেঙে পড়ছে
যেখানে পাখির ডাক নেই, নেই একফোঁটা তুচ্ছ শিশির।
অনেক অভিজ্ঞ আমি আজ, মৃতদের সমান অভিজ্ঞ।
(ভাঙন: কাফনে মোড়া অশ্রু বিন্দু)

হুমায়ুন আজাদ বাংলা কবিতার ইতিহাসে তার নির্মাণশৈলী, অনুভূতি বিবৃতি ও রূপক ব্যঞ্জনা প্রয়োগে নতুন সীমা চিহ্নিত করেছেন। কবিতা সব শিল্পের মধ্যে আধুনিক এ উচ্চারণে আস্থা স্থাপন করে কবিতা পাঠককে দিয়েছেন নতুন পথের দিশা। শব্দের সঙ্গে শব্দের মিলন রচনা করে যে কবিতা সৃষ্টি করেছেন হুমায়ুন তা আমাদের যাপিত জীবন, জগৎ-সংসারের মহৎ সম্ভাবনা, অবসাদ ও সংগ্রাম থেকে জারিত। হুমায়ুন আজাদের কবিতায় বাংলাদেশের ছোট জনপদ রাঢ়িখাল, দ্বীপের মতো গ্রাম, সংগ্রামী কৃষক, মধ্যবিত্ত নাগরিক ও রাজনীতির জটিল ঘূর্ণি বুদ্বুদ হয়ে বিপুল জলরাশির প্লাবন ধারণ করেছেন। হুমায়ুন আজাদ বাংলা কবিতায় স্বতন্ত্র একটি কণ্ঠ উদ্দীপ্ত করেছিলেন। কবিতা চিন্তার মুক্তি, চিত্তের প্রসারতা ও আবেগ-অনুভূতির দ্যোতক। হুমায়ুন আজাদ এ সত্যের কাছে নতজানু কবিতাকে শিল্পনন্দন করেছিলেন। তার কবিতা পাঠককে সমৃদ্ধ করে।


কৃতজ্ঞতা: http://taiyabs.wordpress.com/2009/05/02/ha-9/

Tuesday, November 2, 2010

মানিক বন্দোপাধ্যায় - চিহ্ন


অনেক অপন্যাসের ভিড়ে একটি উপন্যাস পড়লাম। উপন্যাসের নাম চিহ্ন, ঔপন্যাসিক মানিক বন্দোপাধ্যায়। উপন্যাসটি যেন জীবনের অনৈতিক অংশ থেকে নৈতিক দিকে উত্তরণের একটি প্রচেষ্টা, একটি জাগরণ, একটি মহাবিপ্লব। আমাদের মনের যে দিকটাকে আমরা অতিশুদ্ধ বলে জানি তাও যে অধ:পতনের রুপান্তর হতে পারে তা দেখানো।

উপন্যাসে আছে অনেকরকম কৌতূহলউদ্দীপক চরিত্র। যে কোন ছায়াছবি অপেক্ষা যেন আরো অনেক বেশী রোমাঞ্চকর, অনেক বেশী অভিযানময়। আছে মানবমনের বিভিন্ন দিক নিয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। ঔপন্যাসিককে ঠিক গতানুগতিক মনে হয় না। বিজ্ঞানীর মতই যেন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে চিত্রায়িত করেছেন অসাধারণ সব ঘটনার প্রবাহ।

কিছু অংশ উদ্ধৃত করলাম।

(হেমন্ত সম্পর্কে প্রগতিশীল চরিত্র সীতা)
“হেমন্তের দোষ নেই! এমন যার মা, আতুঁড় থেকে আজ এত বয়স পর্যন্ত যার জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত এই মা নিয়ন্ত্রণ করে এসেছে, তার হৃদয়-মনের গঠনের ত্রুটির জন্য সে নিজে কতটুকু দায়ী। এটুকু সীতা জানে যে শৈশবে মনের যে গঠন হয় জীবনে তার আর পরিবর্তন হয় না। সজ্ঞান সাধনায় পরবর্তী জীবনে চিন্তা ও অনুভূতির জগতে নতুন ধারা আনা যায় আপসহীন অবিশ্রাম কঠোর সংগ্রামের দ্বারা। নিজের সঙ্গে লড়াই করার মতো কষ্টকর, কঠিন ব্যাপার আর কি আছে জীবনে। বুদ্ধি দিয়ে যদি বা আদর্শ বেছে নেয়া গেল, কর্তব্য ঠিক করা গেল, সে আদর্শ অনুসরণ করা, সে কর্তব্য পালন করা যেন ঝকমারি হয়ে দাঁড়ায় যদি তা বিরুদ্ধে যায় প্রকৃতির। ইন্টেলেকচুয়ালিজমের ব্যর্থতার কারণও তাই! বুদ্ধির আবিষ্কার, বুদ্ধির সিদ্ধান্ত কাজে লাগানোর চেয়ে অন্ধ অকেজো ভালোলাগা ও পছন্দকে মেনে চলা অনেক সহজ, অনেক মনোরম। বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে তাই অধ:পতন এত বেশি। এত বেশী হতাশা। কথার এত মারপ্যাঁচ। এত ফাঁকিবাজি। বিশ্বাসের এমন নিদারুণ অভাব।”
– পৃষ্ঠা: ৩৭

কথা কি মূল্যহীন?
“কথা কত সহজে কি অনিবার্যভাবে কাজে রুপান্তরিত হতে পারে? কন্ঠের প্রতিবাদ পরিণত হতে পারে জীবনপণ ক্রিয়ায়!”
– পৃষ্ঠা: ৯

মৃত্যুর পরের বাস্তবতা,
“মরেই যে গেছে, বিশেষ করে যাকে স্পষ্টই চেনা যায় কুলি বা চাকর বলে, তার জন্য হাসপাতালের লোক বেশী আর মাথা ঘামাতে চায় না। মরণের খবর জানবার প্রয়োজন যেন কিছু কম তার আপনজনের , প্রাণহীন শরীরটা যেন কিছু কম মূল্যবান তাদের কাছে।“
– পৃষ্ঠা: ৩১

মৃত্যুপথযাত্রী আন্দোলনকর্মী রসুলের মা,
“আবদুলেরও ঘুম হয় নি, তার চোখ দুটিও টকটকে লাল হয়ে উঠেচে। সে চোখের দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে ঘুমন্ত শহরের শেষরাত্রির শেষরাত্রির স্তব্ধতা যেন প্রশ্ন হয়ে ওঠে আমিনার কাছে: তোর কি শুধু একটি ছেলে?

কে নিজের ছেলে কে পরের ছেল ভাববার ক্ষমতা নিজের ছেলেই তার লোপ পাইয়ে এনেছে ক্রমে ক্রমে। অজানা অচেনা অসংখ্য ছেলে তার রসুলের সঙ্গে হতাহত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে তার বুকের মধ্যে।”
– পৃষ্ঠা: ৪৬

ছাত্র রাজনীতির ওপর বলিষ্ঠ সব মতবাদ ব্যক্ত হয়েছে এই উপন্যাসে। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্ফুলিঙ্গ। সে রাজনীতি কি আর আজকের রাজনীতি কি! রাজনীতির কৌশল সবই আছে শুধু নৈতিকতাটা নাই! আর আছে প্রকট লোলুপতা।